প্রাচীন কাল
সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই ময়মনসিংহের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল অর্থাৎ সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ফরিদপুর বছরের প্রায় আট/নয় মাস পানির নিচে থাকতো। ফলে জনবসতি ছিল কম। এ অঞ্চল থেকে পানি সাগরের দিকে নেমে গেলে বছরের চার পাঁচ মাস সময়ে পাশ্ববর্তী কায়েম অঞ্চল থেকে লোকজন আবাদ বসত চালু রাখার জন্য ভীড় জমাতো। সেই শুকনো মৌসুমে কতিপয় মেহনতি মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে পরবর্তী বছরে প্লাবনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জাংগাল (বাঁধ) তৈরী করত। ফলে জাংগালের মধ্যকার জলাভূমি কিছুকালের মধ্যেই কায়েমী অঞ্চলের আকার ধারণ করত। ধারণা করা হয় সমূদ্রতট থেকে সমতট শব্দটির উৎপত্তি। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর সঙ্গে প্রায়ই ঐক্যমতে ডাঃ কালিদাস নাগ, পিএইচডি তদানিন্তন বঙ্গের পূর্বের নিম্নাঞ্চলকে অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গের প্রায় অংশকেই সমতট বলে আখ্যা দিয়েছেন। ময়মনসিংহের অধিকাংশ এলাকাই এই সমতটের অন্তর্গত সমতল ভূমি। শশাঙ্ক ৬১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন, জ্ঞান সমগ্র আর্য্যবর্তে বাঙ্গালীদের সম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন এবং আংশিক সে স্বপ্নকে সফল করেন (R.C. Mojuccedu Bangladesher Itihash-P-31)। পরবর্তী যুগে বাঙ্গালী বংশোদ্ভুত শেরশাহের পুত্র সলিম শাহ শের শাহের মৃত্যুর পর জালাল উদ্দিন খাঁ সলিম শাহ নাম ধারণ পূর্বক দিল্লীর মসনদে আরোহন করেন। তিনিই একমাত্র বাঙালী যিনি দিল্লির মসনদে শেরশাহের পুত্র রূপে আরোহণ করে আট বৎসর রাজত্ব করেন (১৫৪৫-১৫৫৩ খৃঃ)। তিনি পাবনা জেলার চাইমোহর থানার অন্তর্গত সমাজ নামক গ্রামে জন্মলাভ করেন ও প্রতিপালিত হন এবং পরে দিল্লী গমন করে পিতার সহিত মিলিত হন ও শাহী মসনদে আরোহন করেন। পাল রাজাগণের সময় এ অঞ্চলের শাসকদের লাট, চাট, ভাট ইত্যাদি পদ দেয়া হত। সম্ভবত এই ভাট হইতেই বঙ্গদেশের যমুনা নদীর ও রাজমহলের নিম্নেদেশ - পাবনা ও ফরিদপুর অঞ্চল ভাটের দেশ বলে পরিচিত। পাবনা জেলা ও তৎকালে সিরাজগঞ্জ মহকুমায় যে বিরাট চলনবিলের অস্তিত্ব বর্তমান তা দৃষ্টে ও পাবনা জেলার ইতিহাস (রাধা রমন সাহা-১-৩ খন্ড), অধ্যাপক আব্দুল হামিদ এর চলনবিলের ইতিকথা ও প্রমথবিশীর চলনবিল গ্রন্থে যে ঐতিহাসিক বর্ণনা বিভিন্ন ভাবে পাওয়া যায়, তৎসঙ্গে হজরত শাহ জালাল (রঃ) জীবনী গ্রন্থ (কৃত চৌধুরী গোলাম আকবর) এর খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের টাঙ্গাইলের ইতিহাস এবং করটিয়া খান পন্নী সাহেবের নিজস্ব ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে রাজমহল পাহাড় হতে টাঙ্গাইলের দক্ষিণে আটিয়া গ্রামের পশ্চিম পাশের লৌহজং নদী পর্যন্ত বিশাল জলধিতল ছিল (আটিয়া শাহী মসজিদ লৌহজং নদীর পূর্বতীরে প্রতিষ্ঠাকাল ১৬০৯)। সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালে কাগমারীর দরবেশ হযরত শাহ জালাল (রঃ) এবং তার মামা শাহানশাহ হযরত বাবা আদম (রঃ) কাশ্মিরী এ অঞ্চলে আগমন ও ইসলাম প্রচার করেন। তাঁদের জীবনীতেই বিশাল জলধির মধ্যে চর জাতীয় প্রাচীন ভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে শাহজাদপুরে হযরত শাহদৌলা মখদুম (রঃ) সিরাজগঞ্জে হযরত শাহ সিরাজউদ্দিন, নওগাঁতে দাদাপীর, রাজশাহী জেলার বাঘাতে শাহাদৌলা জামী দানেশমন্দ (রঃ) এবং চর মধ্যাহ্ন দ্বীপে বারুহাস ইমামবাড়ী পীর সাহেবের আগমন ঘটে।
মধ্য যুগ
১১৯৩ খৃষ্টাব্দে কুতুব উদ্দিন আইবেক দিল্লী জয় করেন। কুতুব উদ্দিন তার অনুচর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে বাংলা ও বিহার জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ খৃষ্টাব্দে বাংলা জয় করেন ও এ অঞ্চল মুসলিম শাসকদের অধীনে আসে। এদেশে মুসলিম বিজয়ের ১৪০ বছর পর ইবনে বতুতার সফর নামা এবং ২০০ বছর পর মাহুয়ানের বিবরণ এই দুটো মিলিয়ে দেখলে আমরা খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মুসলিম বিজয়ের ১৫০ বছরের মধ্যেই সিরাজগঞ্জের অধিবাসীদের জীবনে ইসলাম একটা অপ্রতিরোধ্য ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে এবং ২০০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ যখন চৈনিক দূত মাহুয়ান এদেশে সফর করেন, তখন সিরাজগঞ্জের জনসাধারণের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিল। মাহুয়ানের সফরের সময় সিরাজগঞ্জ তথা ভাটি অঞ্চলের জনসাধারণ তখন কেবল মুসলমান হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তাই নয়, বরং স্বাধীন গোষ্ঠি হিসেবে সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলের জনসাধারণ তখন মিথ্যা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে জানত না। এভাবেই তারা ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীনভাবেই বসবাস করছিল। ১৫৩৮ সালে মোঘল বাদশা হুমায়ূন গৌড় দখল করেন (সেপ্টেম্বর ১৫৩৮ খৃষ্টাব্দ)। গৌড়ের সুরম্য প্রাসাদাবলী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বাদশা হুমায়ূন খুবই মুগ্ধ হন এবং তিনি এর নাম রাখেন জান্নাতাবাদ।
মুঘল আমল
মুঘল আমলে (১৫৩৮-১৭৪০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত) সুবা বাংলাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৯টি সরকারে এবং ৬৮২টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল। সেই সরকার গুলির মধ্যে ‘সরকার বাজুহা’ আকার আয়তনে ছিল অনেক বড়। তৎকালে সরকার বাজুহাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৩২ টি মহলে বিভক্ত করে। সে সময় সরকার বাজুহা মোট রাজস্ব ছিল ৩৫,১৬,৮৭১ দাম যা টাকার হিসেবে ৯,৮৭,৯২১ টাকা (১ টাকা = ৪০ দাম)। সিরাজগঞ্জ জেলাটি সেই সরকার বাজুহার অন্তর্গত হলেও ৩২টি মহলের কোনটির মধ্যে অবস্থিত সেটা ধারণা করা কঠিন। ‘‘সরকার বাজুহার’’ মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত মোমেনশাহী, ভাওয়াল বাজু ও ঢাকা বাজু উল্লেখ আছে। কিন্তু সিরাজগঞ্জ নামে আমরা কোন মহলের নাম দেখি না। সিরাজগঞ্জ যে সরকার বাজুহার মধ্যকার একটি এলাকা এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ঢাকার কিছু এলাকা এবং ভাওয়ালগড় সহ বৃহত্তর মোমেনশাহী জেলার সমগ্র এলাকাই ছিল সরকার বাজুহার অন্তর্গত। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৮৪৫ সনের পূর্ব পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ ছিল মোমেনশাহী জেলার অন্তর্গত। ঈশা খানের আমলে সাগরের মতো যমুনা নদীর অথৈ পানি ছুটে চলতো এপার থেকে ওপার দশ বার মাইল জুড়ে। সিরাজগঞ্জ শহরটি যেখানে এখন অবস্থিত, সেখানটিতে জনমানুষের বসতি ছিল না সে আমলে। যমুনা নদীর মাঝি মাল্লারা সেখানে কখনো নৌকা ভিড়াতো না। সে এলাকাটি তখন লোকে বলতো ভুতের দিয়ার। এ নিয়ে রয়েছে বহু জনশ্রুতি। রাত্রি হলেই নাকি হাজারে হাজারে লাখে লাখে ভুত সেই দিয়ারে হাজির হত। যদি কোন নৌকা বিপাকে পড়ে সেই ভুতের দিয়ারের ধার কাছ দিয়ে রাত্রিকালে উজান ভাটি চলতো, তাহলে দেখা যেত নৌকার মাঝি মাল্লা চরনদারদের ঘাড় মটকিয়ে রেখেছে ভুতেরা। তবে এখনো সিরাজগঞ্জ আদি শহরটি যে মৌজাতে অবস্থিত, তার নাম বহাল তবিয়তে ভুতের দিয়ার রূপেই টিকে আছে। বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন এলাকা এবং সদর ভূমি অফিস, পৌরসভা কার্যালয় ভুতের দিয়ার মৌজায় অবস্থিত।
বৃটিশ আমল
বৃটিশ আমলের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের ৬৮২টি পরগনাকে জেলা হিসাবে গণ্য করা হয়নি। প্রথমে মুসলিম আমলের প্রশাসনিক কাঠামোকে পরিবর্তন করা হয়েছে। তারপর বাংলাদেশের প্রশাসনিক তাগিদ পূরণের উদ্দেশ্যে সারা দেশের মধ্যে মাত্র ৪/৫জন জেলা কালেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে নোয়াখালী, রংপুর, ঢাকা, ও মোমেনশাহী এই চারটি জেলা কালেক্টরেটের সাহায্যে বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল দেশ শাসন করা হতো। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলে সিরাজ আলী চৌধুরী নামে এক সম্ম্ভ্রান্ত জমিদার ছিলেন সোহাগপুরে। ১৭৮৭ সালে মোমেনশাহী জেলা স্থাপিত হয়। এই একই বছরে লর্ড কর্ণওয়ালিসের কাছ থেকে বড় বাজু পরগনার সাত আনা হিস্যা সিরাজ আলী চৌধুরী ‘সিরাজগঞ্জ জমিদারী’ নামে পত্তনী লাভ করেন। কিন্তু বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে জমিদারের হাতে যেহেতু প্রশাসনিক ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়নি, সেহেতু সিরাজগঞ্জ ছিল মোমেনশাহী জেলার প্রশাসনিক আওতায়; তখন জামালপুর, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতিও মোমেনশাহী জেলার আওতাধীন ছিল। ১৭৯০ সালে মোমেনশাহী জেলার কালেক্টর সাহেব বিশাল মোমেনশাহী জেলার স্থানে স্থানে থানা স্থাপনের তাগিদে ঢাকা রেভিনিউ বোর্ডের কাছে পরানগঞ্জ, কটিয়াদী, চাঁদগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, জগনাথগঞ্জ, শের মদন, শের দিবার দিয়া, শের মাচরা প্রভৃতি স্থানের প্রস্তাব পেশ করেন। ১৭৯২ সালের মধ্যে সিরাজগঞ্জসহ ঐসব এলাকায় প্রথম বিলেতি প্যাটার্নের থানা স্থাপিত হয়। ১৮৪৫ সালে মোমেনশাহী জেলায় ধরমচান্দ ঘোষ প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়ে আসেন। ম্যাজিস্ট্রেট মোমেনশাহী জেলার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুইটি মহকুমা স্থাপনের প্রস্তাব করেন। শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, হাজীপুর ও পিংনাসহ ৪ থানা নিয়ে ১৮৪৫ সালে জামালপুর মহকুমা এবং নিকলী, বাজিতপুর, ফতেপুর ও মাদারগঞ্জ এই ৪ থানা নিয়ে হুসেনপুর বা নিকলী মহকুমা স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সরকার সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর মহকুমা দুইটি স্থাপনের অনুমতি দেন। ফলে ১৮৪৫ সালে বিশাল মোমেনশাহী জেলার অধীনে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ নামে দুইটি মহকুমার সৃষ্টি করা হয়। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা যায়, পরবর্তীকালে মোমেনশাহী জেলাকে বিভক্ত করে ১৮৬৫ সালে কিশোরগঞ্জ, ১৮৬৯ সালে টাংগাইল এবং ১৮৮২ সনে নেত্রকোণা মহকুমা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে ১৮২৮ সালে রাজশাহীর একাংশ নিয়ে পাবনা জেলার পত্তন হয়েছিল। সিরাজগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৮৫৫ সালে যমুনা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে সিরাজগঞ্জ থানাকে পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় (পাবনা গেজেট পৃষ্ঠা নং ৪৩)। ১৮৭৫ সালে রায়গঞ্জ থানাকে সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করে সিরাজগঞ্জের প্রশাসনিক বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
মুক্তিযুদ্ধ ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা
মুক্তি সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনে এক অবিষ্মরণীয় অধ্যায়। সিরাজগঞ্জের আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতার শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে এই সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম ভাগেই স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, যানবাহন, রেলস্টীমার, মিল কারখানা সব বন্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা দেন ও আওয়ামীলীগ কর্মীবৃন্দ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএলএ এবং সদস্য সচিব ছিলেন জনাব আনোয়ার হোসেন রতু। একই সাথে জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, যার আহবায়ক ছিলেন আলমগীর। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ৩ মার্চ, ১৯৭১ জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তৎকালীন ছাত্র নেতা জনাব এম.এ রউফ পাতা প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখ হতে আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলেজ মাঠ ও স্টেডিয়াম মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কলেজ মাঠে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান, ল্যান্স নায়েক লুৎফর রহমান অরুন এবং রবিউল ইসলাম (গেরিলা)। স্টেডিয়াম মাঠে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সহকারী আনসার কমান্ডার বাহাজ আলী, সেনা সদস্য আমজাদ হোসেন ও রাইফেল ক্লাবের সদস্য জহুরুল ইসলাম মিণ্টু ।
পাক বাহিনী যাতে সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য শাহজাদপুর উপজেলাধীন বাঘাবাড়ী ফেরীঘাটে স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শহীদ শামসুদ্দিন উক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধে সার্বিকভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এমনকি তিনি অস্ত্রাগার হতে সকল অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। প্রবল প্রতিরোধের কারণে এক মাস পর ২৬ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী প্রবেশ করেই নির্বিচারে শহরের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, লুটতরাজ করে, নিরীহ জনগনকে হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতন করতে থাকে।
পাক সেনারা সিরাজগঞ্জ দখল করার পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধারা উচচতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং আধুনিক অস্ত্রের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে ভারতে গমন করেন। ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাগণ সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে যুব শিবিরের নেতৃত্বে ভদ্রঘাট, ব্রক্ষ্মগাছা ও নওগাঁর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম যুদ্ধ ছিল। ৭ নং সেক্টরের এফ উইং এর নেতৃত্বে কাজিপুর থানা দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দুবার থানা আক্রমণ করেন এবং বড়ইতলীতে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সকল যুদ্ধে বেশ কিছু পাকসেনা হতাহত হয় এবং সাত জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৭ নং সেক্টরের এফ উইং এর নেতৃত্বে বেলকুচি থানা দখলের জন্য আরও একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা থানার দখল গ্রহণ করে থানার সকল অস্ত্র হেফাজতে নেন এবং ১২ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করেন। এতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। বেলকুচির রাজাপুর, শমেসপুর ও কালিয়াহরিপুর ব্রীজে এফএফদের নেতৃত্বে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পলাশডাঙ্গা যুব শিবির, এফএফ ও বিএলএফ এর মুক্তিযোদ্ধাগণ একে একে তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও শাহ্জাদপুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ঐ সকল এলাকা দখল করে নেয়। সবশেষে ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সিরাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাগণের অধিকাংশ দল একত্রে সিরাজগঞ্জ শহরের উত্তরে শৈলাবাড়ি পাক হানাদার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এখানে সিরাজগঞ্জ এর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে পাক বাহিনী পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে এবং তারা ব্যাপকভাবে হতাহত হয়। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ার আহসানুল হাবিব ও সোহরাব আলীসহ ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অবশেষে মিত্র বাহিনীর কোনরূপ সহায়তা ছাড়াই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সিরাজগঞ্জ এর বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সিরাজগঞ্জ শহরকে এবং ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সমগ্র সিরাজগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করেন। সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্নস্থানে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে যে সকল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএলএ, মরহুম আব্দুল মোমিন তালুকদার এমএলএ, সৈয়দ হায়দার আলী এমপিএ, মরহুম রওশনুল হক এমপিএ, আনোয়ার হোসেন রতু, মরহুম শহিদুল ইসলাম তালুকদার, মরহুম আমির হোসেন ভুলু, মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জা, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুস সামাদ, ইসমাইল হোসেন, জহুরুল ইসলাম তালুকদার, গোলাম হায়দার খোকা, আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, মোজাফ্ফর আহমেদ, ইসাহাক আলী, এম এ রউফ পাতা, বিমল কুমার দাস, শেখ আলাউদ্দিন, সোহরাব আলী, আমজাদ হোসেন মিলন, লুৎফর রহমান অরুণ, খ ম আকতার হোসেন, ফজলুল মতিন মুক্তা, টি এম শামীম পান্না, মরহুম শাহ্জাহান আলী তারা, মরহুম ইসমাইল হোসেন, শফিকুল ইসলাম শফি প্রমুখ।
অর্থনৈতিক অবস্থা
সিরাজগঞ্জ জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময়। এখানকার জনসাধারণের আয়ের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে কৃষি, তাঁতশিল্প, বস্ত্রশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য চাষ, দুগ্ধশিল্প, মৃৎশিল্প, কুটির শিল্প ইত্যাদি। জনসাধারণের প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এছাড়া তাঁত সমৃদ্ধ হওয়ায় জেলার প্রায় সকল উপজেলাতেই বিপুল পরিমাণে তাঁত বস্ত্র উৎপাদন হয়। এ সকল তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত সূতা ও বস্ত্র কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে এ জেলায় বিরাট অংকের আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ ও দুগ্ধজাতপণ্য উৎপাদন কারখানা মিল্কভিটা এ জেলায় অবস্থিত। এ কারখানাকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু পালন করা হয়। যার সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠির জীবন জীবিকা জড়িত। এ জেলার শাহজাদপুর উপজেলায় বাঘাবাড়ি নৌ-বন্দর অবস্থিত। সেখানে ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানাসহ পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের ডিপো অবস্থিত। এসকল স্থাপনায় ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক নিয়োজিত থেকে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। যমুনা নদী ও চলনবিল অধ্যূষিত এ জেলায় বিপুল সংখ্যক বড় বড় আকারে দীঘি ও পুকুর বিদ্যমান। ফলে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মৎস্য চাষ, আহরণ, ক্রয়-বিক্রয় এর মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সব মিলিয়ে এ জেলার জনসাধারণের জীবন জীবিকা বৈচিত্র্যময় তবে জেলার ৫টি উপজেলা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় এবং সে সকল উপজেলার ২০টির মত ইউনিয়ন নদীর চরাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের এ সকল লোকজন প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গন ও বন্যার সম্মুখীন হয়। ফলে নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগ এ জেলার জনসাধারনের নিত্যসঙ্গী। এ সকলের ভারে এ এলাকার জনসাধারণ জর্জরিত। ফলে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্র ও বেকার।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি
সাহিত্য ও সংস্কৃতি চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এই প্রকাশ নানাভাবে নানা খাতে প্রবাহিত হয়। সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা একদিনে গড়ে উঠে না। যুগ-যুগান্তরের মিলন ও একাত্মতা একে সার্থক ও সমম্বিয়ত করে। বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় তা লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জের সম্পর্ক রংপুর, বগুড়া, পাবনা সদর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার সংগে। যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্য জনিত কারনেই এই যোগাযোগ চলছে বা চলে আসছে। অধুনা রাজশাহী ও নবাবগঞ্জের সাথে রেল সংযোগ থাকায় যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও কুষ্টিয়ার লোক সাহিত্য, ফকিরী, মুর্শিদী, মারফতী গান-গজল, লোক কাহিনী প্রভৃতির মধ্যে একটা স্বতন্ত্র ভাব লক্ষ্য করা যায়। এই স্বতন্ত্রতা বরেন্দ্রভূমি রাজশাহী-নাটোরের প্রভাবমুক্ত। এই ভাবধারা পাশাপাশি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। রংপুর, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া বলয়ের সাহিত্য সংস্কৃতি ভিন্ন গতিপ্রকৃতি বিশিষ্ট, ইসলামী চিমত্মা ধারার প্রতিফলন এতে বেশী স্পষ্টতর হয়। সাহিত্য, সংস্কৃতির এই প্রবাহ যদিও তর্কাতীত নয়, তবু দৃশ্যমান ও প্রকট স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য স্বীকার্য সত্যরূপে প্রতীয়মান। সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের মধেই সম্বনয় সাধন প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে ও থাকা দরকার। সিরাজগঞ্জের নাটকের স্থান পূর্ব থেকেই উন্নত, এখনও এখানে নাটক, যাত্রা অভিনীত হয় বেশী। কলিকাতার বিখ্যাত নটরাজ ছবি বিশ্বাসের বাড়ী সিরাজগঞ্জ থানার বাগবাটি গ্রামে ছিল। প্রখ্যাত আইনজীবি অমিত বাবু ছিলেন নাটক প্রিয়। এখনও বহু নাট্যকার বর্তমান। পূর্বের নাট্যশালা এখন পৌর মিলনায়তনে পরিবর্তিত হয়েছে। এখানেও নাটক মঞ্চস্থ হয়। অন্যান্য স্থানের মত সিরাজগঞ্জের কবিতা চর্চা অনেক বেশী। যখনই কোন পর্ব আসে, তখন কবিতার ঢল নামে। এখন ছন্দের প্রতি অনুরাগ নাই। আধুনিক কবিতার প্রতি অনুরাগ বেশী। তদুপরি কবিতার অবোধ্য, দুর্বোধ্য ভাষা ও শব্দ সংযোজনের প্রবণতা লক্ষ্যণীয় সিরাজগঞ্জের সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা প্রবাহমান রাখতে চেষ্টা করছে শহর ও পল্লীর বিভিন্ন সাহিত্য-পত্র পত্রিকা, সাময়িকী এবং প্রবীণ ও তরুন কবি সাহিত্যিকগণ ও শিল্প সাহিত্য সংবাদ ও গোষ্ঠী। তন্মধ্যে যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী, উদিচী, বাস্কার শিল্পী চক্রের নাম উল্লেখযোগ্য।